সুখুর গল্প! যে গল্প আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে।

অনেক কাল আগের কথা। এক গ্রামে একটা লোক ছিলো, নাম সুখু। সুখু অনেক কষ্টে দিন যাপন করতো। পেশা হিসেবে ছিলো শহর থেকে তেল কিনে এনে গ্রামে তেল বিক্রি করা। তখন তেলের দাম ছিলো অনেক। মানুষ খুব অল্প অল্প করে তেল ব্যবহার করতো। যাইহোক, প্রতিদিন তেল বিক্রি করে যে টাকা পেত তাই দিয়ে কোন মতে দিন কেটে যেত সুখু ও তার পরিবারের। আর পরিবার বলতে ছিলো বৃদ্ধ মা।

একদিন সকালে তেল কিনতে গিয়ে একটু কম দামে তেল কিনতে পারলো সুখু। কমদামে কিনতে পারা মানে বিক্রি করে একটু বেশি লাভ হবে। তার মন খুব খুশি এই ভেবে। তো শহর থেকে গ্রামে হেঁটে যেতে যেতে দুপুর হয়ে গেছে, সুর্য টা ঠিক মাথার উপরে। ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের নিচে একটু আরাম করতে বসলো আর ভাবা শুরু করলো আজকে যে একটু বেশি লাভ হবে সেই টাকা দিয়ে কি করবে……

“আজকে যে টাকা টা বেশি হবে টা দিয়ে দুইটা হাঁসের বাচ্চা কিনবো। মা বাচ্চা দুটো কে পালবে আর দেখাশুনা করবে। হাঁস দুইটা বড় হয়ে ডিম দিবে। তারপরে ডিম থেকে আরো কয়েকটা হাঁস হবে। এইভাবে আস্তে আস্তে বাড়তে হবে। হাঁস গুলো বড় হলে বিক্রি করলে বেশ ভাল টাকা পাওয়া যাবে। এইভাবে করে যে টাকা পাওয়া যাবে সেটা জমিয়ে জমিয়ে একটা গরু্র বাচ্চা কিনবো।

এরপরে বাচ্চা গরু টা যখন বড় হবে, তখন একটা বাচ্চা দিবে। বাচ্চা টা বড় হয়ে ষাঁড় হলে বিক্রি করে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। তখন আবার আরেকটা গাভী কেনা যাবে। সাথে সাথে দুধ ও বিক্রি করা যাবে। আচ্ছা, এত গরু কোথায় রাখবো আর পালবো? বাড়ির পাশে এক টুকরো জমি আছে যেটা শুনেছি বিক্রি হবে। তাহলে হাঁস, গরু বিক্রির টাকা টা জমিয়ে অই জমি টুকু কিনে ফেলবো। এইভাবে বেশ টাকা জমিয়ে ঘর টাও ঠিক ঠাক করে ফেলা যাবে। তখন আর অভাব থাকবে না।”

এই স্বপ্নের মাঝেই সুখুর মনে হলো মা তো বৃদ্ধ। তার মানে এইসব করতে করতে তিনি মারাও যেতে পারেন। তখন আবার ভাবা শুরু করলো…

“যদি মা মারা যায় তাহলে কি হবে! আমি তো একা হয়ে যাবো। আর বয়স তো কম হলো না, একটা বিয়ে করে ফেলাই যায়। পাশের গ্রামে তেল বিক্রি করতে গিয়ে যে একটা মেয়ে দেখতাম ময়না, পরীর মত সুন্দরী ওকে বিয়ে করবো। এরপরে সুখের সংসার হবে।

বিয়ের পরে পরে বাচ্চা নেবো দুইটা। একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে হলে খুব ভালো হবে। ছেলে মেয়ে কে স্কুলে পড়াবো। আর আমি ত অনেক পরিশ্রম করবো। টাকা জমাতে পারলে আরেক টুকরো জমি কিনবো। সেখানে ধান চাষ করবো। তখন আর কোন অভাব থাকবে না।”

ভাবতে ভাবতে সুখু স্বপ্নের ভিতরে চলে গেলো। ভাবতে লাগলো কিভাবে কি করবে। কেমন করে দিন যাবে। ছেলেমেয়েরা সকালে স্কুলে যাবে আর সুখু যাবে মাঠে কাজ করতে। সুখুর বউ ঘরের কাজ আর রান্না বান্না করবে। এরপরে ভাবতে লাগলো…

“আচ্ছা, আমার আর আমার বউ এর মাঝে কি কখনো মান অভিমান হবে? ছোট খাট হলে ভালো হয়। যেমন, একদিন আমি আসবো দুপুরে মাঠ থেকে এসে দেখবো রান্না হয় নাই। ওইদিকে ছেলেমেয়েরাও চলে আসছে স্কুল থেকে। ওদের ও খিদা পেয়েছে। খুব রাগ হচ্ছে আমার। রাগ করে বসে আছি বারান্দায়। এরমধ্যে বউ তাড়াতাড়ি করে রান্না শেষ করে মেয়েকে পাঠালো আমাকে ডাকতে। কিন্তু আমি তো ভীষণ রাগ করে আছি। মেয়ে এসে আমার হাত বলে বললো, বাবা খেতে আসো। কিন্তু তখন তো আমি রাগ করে আছি। মেয়ের হাত ছুটায়ে পা দিয়ে মাটিতে জোরে ধাক্কা দিয়ে বললাম, খাবো না আমি আজকে ভাত।”

এমন সময় সুখু অনুভব করলো তার পা এ কিছু একটা লেগেছে, মনে হচ্ছে ভিজে গেছে। হকচকিয়ে উঠে পড়লো। এখানে শেষ হয়ে গেলো তার সব স্বপ্ন।

গল্প টা আমার না, ছোটবেলায় বাবার থেকে শুনেছি। বাবার কাছে যখন ভবিষ্যতে কি করবো তাই নিয়ে বড় বড় ভাবনা বলতাম, তখন এই গল্প বলে বুঝিয়েছেন এতো পরের কথা না ভেবে এখনের সময় কাজে লাগাতে হবে। এখন সবকিছু ঠিক ঠিক করতে থাকলে আস্তে আস্তে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে থাকবে। সেজন্য বাবা বলতেন জীবনে শুধু ভাবতে থাকলেই হবে না। সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য যা করতে হয় সেটা করতে হবে। না হলে ভাবতে ভাবতে দেখা যাবে সবকিছুই ভেস্তে যাচ্ছে, যা চেয়েছি কিছুই হচ্ছে না। যেমনটা হয়েছে সুখুর ক্ষেত্রে। ভাবতে ভাবতে এতোটাই গভীর ভাবনায় চলে গেছে যে নিজের পায়ের ধাক্কায় সব তেল ফেলে দিয়েছে। তেল মাটির সাথে মিশে যেতে যেতে তার সব স্বপ্ন ও মিশে গেছে মাটিতে।

Written on July 2, 2020